মা তুমি বিশ্রাম নাও অম্বুবাচী,ভালোবাসা দিয়ে আঁকড়ে ধরা তিন দিন
নিজস্ব প্রতিনিধি, কলকাতা :
দেবীর অম্বুবাচী যাত্রা, রজঃস্বলা ধরিত্রী, জননী রূপে দেবী, ভালোবাসার গভীর ব্যাখ্যা।।শুচিতা নয়, শক্তি; সংযম নয়, সৃষ্টির উৎসব,অম্বুবাচী এক মাতৃত্বের উপাসনা।।
নীলাচলের চূড়ায়, বর্ণহীন শিলার বুকে এক অলৌকিক শক্তি বিরাজ করেন,দেবী কামাখ্যা।এখানে মূর্তি নেই,নেই কোনও সাজসজ্জা, নেই সোনার সিংহাসন,আছেন শুধু এক পবিত্র যোনিপীঠ, যা নিরবধি সিক্ত থাকে রক্তবর্ণ জলে।
এই কামাখ্যা সেই সতী, যাঁর দেহ খণ্ডিত হয়ে যখন পৃথিবীতে পতিত হয়েছিল, তখন যোনি অংশটি এসে পড়েছিল কামরূপে। সেই থেকেই শুরু হয় যোনিস্বরূপা দেবী কামাখ্যার পূজা, রূপ নয়, শক্তির; মূর্তি নয়, মাতৃত্বের উৎসার।
বছরে একবার, আষাঢ় মাসে, দেবী রজঃস্বলা হন। তখন তিনদিন মন্দিরের গর্ভগৃহ বন্ধ থাকে। দেবী বিশ্রামে যান। মন্দিরের পুরোহিত থেকে ভক্ত সবাই মাথা নিচু করে বলে:
❝ মা, তুমি নিজের মধ্যে থাকো,আমরা তোমার সন্তান হয়ে বাইরে বসে থাকি, শুধু ভালোবাসার প্রহর গুনি…❞
এই তিন দিনের এই ঋতুকালই অম্বুবাচী, যা দেবীর শুধু বিশ্রাম নয়,এক আত্ম-প্রস্তুতির সময়, যেন তিন দিন পরে তিনি আবার সৃষ্টি করতে পারেন, আলো ছড়িয়ে দিতে পারেন সমস্ত সংসারে।
অম্বুবাচী কী?
‘অম্বুবাচী’ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত 'অম্বু' (জল) এবং 'বাচী' (বৃদ্ধি) থেকে। অর্থাৎ, যখন গ্রীষ্ম শেষে বর্ষার আগমনে ধরিত্রী সিক্ত হয় এবং উর্বর হয় নতুন প্রাণ সৃষ্টির জন্য, সেই সময়কে বলা হয় অম্বুবাচী।
এই সময় দেবী রজঃস্বলা হন, ঠিক যেমন একজন নারী ঋতুমতী হন সন্তান ধারণের পূর্বে। তাই দেবী তখন বিশ্রামে যান। মন্দিরে পূজা হয় না, দরজা বন্ধ থাকে। ধরিত্রীও তখন বিশ্রাম নেন।
বাংলার কৃষিজীবনে এই সময় চাষাবাদ বন্ধ থাকে, বীজ বপন হয় না, আগুনে রান্নাও নিষিদ্ধ থাকে অনেক ব্রতচারীর জন্য। কারণ মাটি তখন রজঃস্বলা ধরিত্রী,তাঁকে বিশ্রাম দেওয়া, সম্মান জানানো, সেই ধর্ম-সংস্কৃতিরই অংশ।
অম্বুবাচী সময়সূচি : ২০২৫
অম্বুবাচী প্রবৃত্তি শুরু:
৭ই আষাঢ় ১৪৩২ | ২২শে জুন ২০২৫ | রবিবার
দুপুর ২:৫৭ গতে শুরু।
অম্বুবাচী নিবৃত্তি (শেষ):
১০ই আষাঢ় ১৪৩২ | ২৫শে জুন ২০২৫ | বুধবার
রাত ৩:২১ গতে শেষ।
এই তিন দিন মন্দির, আশ্রম, কৃষিক্ষেত্র, সাধকদের ঘরে এবং প্রকৃতির মাঝেও একটি নীরবতা থাকে,এক অনাড়ম্বর আরাধনার নীরবতা।
নারী, ধরিত্রী ও রজঃস্বলা : ভালোবাসার দৃষ্টিভঙ্গি
প্রশ্ন করি নিজেকে
আমরা কি ঘরে আমাদের মেয়েকে, বোনকে, মাকে ঋতুমতী হলে তিরস্কার করি?মুখে কাপড় জড়িয়ে রাখি?রান্নাঘরে ঢুকতে দিই না?খাবার দিই না?
না, বরং আমরা বলি, “তুমি বিশ্রাম নাও।”
তাহলে দেবীর ক্ষেত্রেও কেন নিষেধ, কেন ‘অশুচি’ তকমা?
একজন নারী রজঃস্বলা হন বলেই তিনি জীবন ধারণ করতে পারেন। দেবীও মা, তিনিও রজঃস্বলা হন নবসৃষ্টির জন্য। তাই এই সময় পূজা বন্ধ নয়, বরং ভক্তির রূপ বদলে যায়, জপ, ধ্যান, সংযম ও অপেক্ষায় পরিণত হয়।
কামাখ্যার অম্বুবাচী : মন্দির বন্ধ, হৃদয়ের দরজা খোলা
এই সময় কামাখ্যা মন্দিরের গর্ভগৃহ তিন দিন বন্ধ থাকে, কারণ দেবী যোনিস্বরূপা।
নিবৃত্তির রাতে স্নান, নতুন বস্ত্র, হোম ও বলিদান হয়। এরপর মন্দির খুলে দেওয়া হয় এবং ‘রক্তবস্র’ নামে পরিচিত সেই আবৃত কাপড় ভক্তদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। এই বস্র যে পায়, সে মনে করে দেবীর আশীর্বাদ পেয়েছে অন্তরে।
❝ ১৯৮০ সালে আমার সৌভাগ্য হয়েছিল সেই রক্তবস্র ধারণ করার… তারপর হারিয়ে গেছে, কিন্তু সেই স্পর্শ আজও মনে থেকে গেছে,ঠিক মায়ের কোলের মতন… ❞
শাস্ত্র কী বলে?
তন্ত্রগ্রন্থ ‘বামকেশ্বর তন্ত্র’তে বলা হয়েছে:
“আষাঢ়ে প্রথমে দেবী অম্বুবাচী দিনত্রয়ং।
সংগোপনে গৃহে দেবীং স্থাপয়েদ্বস্ত্রবেষ্টনে।।
রাত্রৌ মহানিশা যোগে পঞ্চাচারেণ দেশিক।
পূজয়িত্বা বলিং দত্বা হোময়িত্বা বিহারয়েত।।"
অর্থাৎ তিন দিন দেবীকে আচ্ছাদিত করে রাখা হয়, পূজা নয়,স্মরণ ও ধ্যানই মুখ্য।নিবৃত্তির রাতে হয় তাঁর নবজাগরণ।
কৃষির সঙ্গে অম্বুবাচীর সম্পর্ক:
এই সময় চাষ বন্ধ থাকে। বর্ষার প্রথম জল মাটিকে সিক্ত করে, উর্বর করে।
এটা এক নিঃশব্দ প্রস্তুতি ফসলের জন্য, প্রাণের জন্য।ঠিক যেমন একজন মা সন্তান ধারণের আগে তাঁর শরীরকে প্রস্তুত করেন।
প্রকৃতি ও নারীর মধ্যে এই সাযুজ্যই অম্বুবাচীর আসল ব্যাখ্যা,যেখানে জীবন সৃষ্টির মূলেই থাকে রজঃস্বলা এক নারী।
পূজা বন্ধ নয়, ভক্তি বদলাক
অনেকে বলেন, এই সময় দেবী অশুচি, তাই পূজা নিষিদ্ধ।
কিন্তু শাস্ত্রে বলা আছে,
সচল বিগ্রহে পূজা, বলি, হোম চলতে পারে।পূজা বন্ধ করলে সেবাপরাধ হয়।এই সময় জপ,ধ্যান, পুনশ্চরণ করলে বহু গুণ ফল হয়।
এমনকি দেবীকে এই সময় “আম ও দুধ” নিবেদন করার রীতিও প্রচলিত।
অম্বুবাচী মানেই ভালোবাসার উপলব্ধি।অম্বুবাচী কোনো নিষেধ নয়, এটি এক উপলব্ধির সময়।
দেবী, নারী, ধরিত্রী, তিন জননী একসাথে রজঃস্বলা হন, বিশ্রামে যান, সৃষ্টির জন্য নিজেদের প্রস্তুত করেন।
আমাদের কাজ,
তাঁদের দিকে তাকিয়ে, একটুখানি নতমুখে, ভালোবেসে বলা,
❝ মা, তুমি বিশ্রাম নাও…আমরা তোমার আলোয়, তোমার স্পর্শে, তোমার সৃষ্টিতে আবার নতুন করে জন্ম নেব… ❞
❝ নারী রজঃস্বলা হয় বলেই মা হতে পারে। দেবীও মা, তিনিও রজঃস্বলা হন। এই সময়টা ত্যাজ্য নয়, পূজনীয়। অম্বুবাচী সেই পূজা, যা চলে নীরবে, নিঃশব্দে, ভালোবাসায়। ❞
PC: Google